সৌভিক পোদ্দার, ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি:
১৩ মে ২০২৫
চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সহায়ক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মানুষ ছোটে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ ব্যবসায় রুপান্তরিত হয়েছে। কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে।ঝিনাইদহে ব্যাঙের ছাতার মত যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল।
যেগুলোর অধিকাংশেরই নেই স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন।নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবেশ নেই। ল্যাবে নেই নমুনা সংরক্ষণের যথাযথ পরিবেশ। বাসাবাড়ি বা গোডাউনে কেউ কেউ শুরু করেছেন এসব প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই অদৃশ্য এক শক্তির বলে চলেছে এসমস্ত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।
ঝিনাইদহ জেলায় ২২৭টি নিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লাইসেন্স নবায়ন করেছে। অনিবন্ধিত অবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে মাত্র ১৪ টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো ২৫ টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
মানহীন যন্ত্রপাতি, অদক্ষ টেকনিশিয়ান ও মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে রমরমা ব্যবসা করে চলেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় এসব বিষয়ে অবগত থাকলেও যেন কিছুই করতে পারছে না। ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে বারবার নির্দেশনা দিলেও তারা মানছে না। স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
অথচ, এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। হচ্ছে ঝুকিপূর্ণ অস্ত্রপচার। অস্ত্রপচারের সময় এ্যানেস্তেসিয়াগত ত্রুটির কারণে মৃত্যুর মুখে ঝুকে পড়ছে অনেকেই। চলতি বছরের ৭ মার্চ কালীগঞ্জের ফাতেমা প্রাইভেট হাসপাতাল এন্ড ইকো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পলিপাস অপারেশন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে উৎস ভট্টাচার্য নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী। ২৯ মার্চ কালীগঞ্জের দারুস শেফা প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল অস্ত্রপচারে লাভলী বেগম নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। ২৮ মার্চ কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে জননী আছিয়া প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল অস্ত্রপচারে সাথী আক্তার নামে আরেক প্রসূতির মৃত্যু হয়। মানহীন এসব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ভুল রিপোর্টের অভিযোগ তো আছেই। মৃত্যুর ঘটনার পরে এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগ বন্ধ করে দিলেও অদৃশ্য শক্তির বলে পূণরায় চলছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিগুলো দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছেন কর্তৃপক্ষ। সকল শর্ত মেনে লাইসেন্স পাওয়া দুরুহ বলে মাসিকভাবে টাকা দিয়ে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলার ছয়টি উপজেলায় নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ২২৭ টি। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬২ টি, হাসপাতাল ৩১ টি। শৈলকুপা উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২০ টি, হাসপাতাল ১১ টি। কালীগঞ্জ উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২৩ টি, হাসপাতাল ১৮ টি। মহেশপুর উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৮ টি, হাসপাতাল ১১ টি। কোটচাঁদপুর উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১২ টি, হাসপাতাল ৯ টি। হরিনাকুন্ডু উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭ টি হাসপাতাল রয়েছে ৫ টি। যেগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশেরই কাগজপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ।
ঝিনাইদহের সমতা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিজের ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে আসা মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় নয় তেমন টেস্টও দিয়ে দিচ্ছেন। আবার অন্য ডায়াগনস্টিক থেকে পরীক্ষা করে নিয়ে গেলে সেটা তারা গ্রহণ করছেন না। আমরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ঝিনাইদহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের জেলায় দুই শতাধিক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই নবায়ন করা হয়নি। মূলত অনলাইন জটিলতা, কোভিড-১৯ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এটি হয়েছে। আগামী জুন ২০২৫ এর মধ্যে এগুলো নবায়নের বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মহাপরিচালকের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি বলেন, যেসমস্ত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোন রকম কাগজপত্র নেই সেগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হোক।
পরিবেশ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের সহকারী পরিচালক মোঃ মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ঝিনাইদহ জেলায় সর্বমোট ১৪ টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। অনুমোদনের জন্য অপেক্ষামান রয়েছে আরো ২৫ টি প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, আপাতত আমার নিকট ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানের কোন তালিকা নেই। একটু সময় লাগবে তালিকা প্রস্তুত করতে। যেসকল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোতে বৈধ কাগজপত্র নেই সবগুলোতে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযান পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, ঝিনাইদহের মাত্র কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। অনেক অভিযোগ পাই, কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আমরা নির্দেশ দিলেও কেউ মানতে চাচ্ছে না। সিলগালা করলে তারা নিজেরাই খুলে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্কৃতায় আমরা বেশি ভুমিকা নিতে পারছি না। তবে আগামী মিটিংয়ে জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।