তরফদার মামুন
প্রতিনিধি, মৌলভীবাজারঃ
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ অনেকদিক থেকে এগিয়ে গেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং জনসচেতনতায় আমাদের সাংবাদিকরা রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায়, একটি জেলা বা শহরে একাধিক সাংবাদিক সংগঠন একসঙ্গে কাজ না করে নিজেদের আলাদা পথে পরিচালিত করছে। এটি সবসময় নেতিবাচক নয়—কারণ ভিন্নমত ও ভিন্ন সংগঠন গণতন্ত্রেরই অংশ। কিন্তু যখন এই পার্থক্য সংঘাত বা ভুল বোঝাবুঝির রূপ নেয়, তখন শুধু সাংবাদিকতার পরিবেশ নয়, সমাজের প্রতিও এর প্রভাব পড়ে। অথচ আমরা যদি একবার পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবি, তাহলে দেখব—ভিন্ন সংগঠন থাকা সত্ত্বেও সবাই একই উদ্দেশ্যে কাজ করছি: জনগণের পক্ষে কথা বলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখা, এবং তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন করা।
এই ঐক্যের জায়গাটিকে সামনে এনে প্রশাসনের একটি সহায়তামূলক ও সমন্বয়কারী ভূমিকা সাংবাদিক সমাজের জন্য অনেক কার্যকর হতে পারে। প্রতিটি জেলার প্রশাসন স্বভাবতই নিরপেক্ষ একটি প্ল্যাটফর্ম, যা সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারে—কোনো পক্ষ নন, বরং সবার পাশে থাকা এক নির্ভরযোগ্য হাত। সেই প্রশাসনের উদ্যোগে একটি “জেলা সাংবাদিক সমন্বয় কমিটি” গঠন করা যেতে পারে, যেখানে জেলার স্বীকৃত সব সাংবাদিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন, আর পুরো কাঠামোটি পরিচালিত হবে জেলা প্রশাসকের পরামর্শে। এতে করে কেউ বাদ পড়ে যাবে না, বরং সবাইকে নিয়ে সামনে এগোনোর পথ তৈরি হবে।
এই সমন্বয় কমিটির প্রথম দায়িত্ব হতে পারে—পেশাগত মর্যাদা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। প্রশাসনের তথ্য অফিসের সহায়তায় জেলার সক্রিয় সাংবাদিকদের একটি ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এখানে সাংবাদিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পত্রিকার নাম, দায়িত্বকাল, এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। এই তথ্যভাণ্ডার থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের একটি একক ডিজাইন অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত পরিচয়পত্র (Press ID) সরবরাহ করা যেতে পারে, যা সব সরকারি দপ্তরে গ্রহণযোগ্য হবে। এটি সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশকে অনেক বেশি সম্মানজনক করে তুলবে এবং ভুয়া পরিচয়ের ঝুঁকিও কমে আসবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন। দেখা যায়, প্রায়শই ভুল বোঝাবুঝি বা মতভেদ থেকে বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় যৌথভাবে “সাংবাদিক প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় কর্মশালা” আয়োজন করা যেতে পারে। এই কর্মশালাগুলোতে সবাই একসঙ্গে বসে শেখার সুযোগ পাবে—কোনো সংগঠনের পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে “পেশা”। রিপোর্টিং নৈতিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, তথ্য যাচাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা—এইসব বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষকের মাধ্যমে সাংবাদিকরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন, যা ঐক্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
তৃতীয়ত, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া সাংবাদিকদের জন্য একটি “জেলা সাংবাদিক সহায়তা কেন্দ্র” গঠন করা যেতে পারে, যা একটি নিরপেক্ষ পরামর্শক ও সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। এখানে সাংবাদিকরা আইনি সহায়তা, তথ্য অনুসন্ধানের সাহায্য, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কিংবা আর্থিক সহায়তা সংক্রান্ত তথ্য পাবেন। এই সহায়তা কেন্দ্র একটি ছোট পরিসরে হলেও, সাংবাদিকদের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং প্রান্তিক সাংবাদিকদের জন্য এটি হতে পারে এক বড় সহায়। জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে একটি সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল গঠন করে এই কেন্দ্রে প্রাথমিক তহবিল জোগান দেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্যাটি বিভিন্ন জেলায় দেখা যায়—তা হলো প্রেসক্লাব পরিচালনা সংক্রান্ত মতভেদ। অনেক জেলাতেই একাধিক সংগঠন প্রেসক্লাব পরিচালনার দাবি তোলে, যা দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এই সমস্যার একটি নমনীয় ও কার্যকর সমাধান হতে পারে—”রোটেশন পদ্ধতিতে প্রেসক্লাব ব্যবস্থাপনা”, যেখানে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট সময় পরপর সংগঠনগুলো প্রেসক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এতে একক কর্তৃত্ব বা বিরোধিতা নয়, বরং সম্মিলিতভাবে পরিচালনার চর্চা তৈরি হবে, এবং সকল সংগঠনের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হবে।
পঞ্চমত, অনেক সাংবাদিক মাঠে কাজ করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েন, এমনকি অনেক সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়। এজন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি “সাংবাদিক নিরাপত্তা রেসপন্স সেল” চালু করা যেতে পারে, যেখানে সাংবাদিকরা মাঠে গিয়ে কোনো ঝুঁকিতে পড়লে দ্রুত সহায়তা চাইতে পারবেন। এর জন্য একটি হেল্পলাইন নম্বর বা জেলা প্রশাসনের মিডিয়া উইং চালু করা যেতে পারে, যেখান থেকে দ্রুত তথ্য যাচাই ও সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এছাড়া, তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবসময় স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। প্রশাসন চাইলে একটি সমন্বিত “তথ্য ও প্রেস রিলিজ বার্তা সিস্টেম” চালু করতে পারে, যেখানে জেলার গুরুত্বপূর্ণ খবর বা সরকারি ঘোষণাসমূহ সবার কাছে একযোগে পৌঁছে যাবে—SMS, ইমেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে। এতে গুজব, বিভ্রান্তি বা ভুল তথ্য কমবে এবং সংবাদ পরিবেশ আরও সুশৃঙ্খল হবে।
সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি মূল্যবোধ—সত্য, ন্যায় এবং জনস্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করা। এই মূল্যবোধকে সম্মান জানাতে হলে, আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতেই হবে। সংগঠনভেদ থাকতে পারে, ভিন্নমতও স্বাভাবিক, তবে সেই ভিন্নতাকে আমরা যদি শক্তি হিসেবে ব্যবহার করি, তাহলে দ্বন্দ্ব নয়—সম্প্রীতি হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রশাসনের মতো একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মের সহযোগিতা থাকলে, ঐক্য অর্জন কোনো দূরের স্বপ্ন নয়।
আমরা আশা করি, ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা হবে আরও মানবিক, আরও বস্তুনিষ্ঠ এবং একে অপরের প্রতি সম্মানবোধে পরিপূর্ণ। আমরা কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নই, বরং আমরা সবাই একসাথে একটি নৈতিক দায়িত্ব পালন করছি। প্রশাসন, সাংবাদিক, তথ্য অফিস এবং সমাজের সচেতন অংশ—সবাই একত্রিত হলেই সম্ভব হবে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে তোলা।